আড়াই দশকে নিঝুম দ্বীপে সবুজ কমেছে ৫০ শতাংশ

-মনিটর রিপোর্ট Date: 30 November, 2024
আড়াই দশকে নিঝুম দ্বীপে সবুজ কমেছে ৫০ শতাংশ

হাতিয়া, নোয়াখালী :  বঙ্গোপসাগরের ‍বুকে মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এক চর নিঝুম দ্বীপ। আইল্যান্ড অব সাইলেন্স বা নিঃশব্দের দ্বীপও বলা হয় একে। চর ওসমান, বাউল্লারচর, কামলার চর, ও মৌলভির চর—বৃহৎ এ চার চর নিয়ে পুরো নিঝুম দ্বীপের বিশাল একটি অংশজুড়ে বনাঞ্চল। 

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ থেকে উপকূলীয় জনপদ রক্ষায় ২০০১ সালে দ্বীপটিকে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। তবে বনাঞ্চল উজাড় ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে দিন দিন কমছে ৪০ হাজার ৩৯০ একর আয়তনের সংরক্ষিত বনটি। গত আড়াই দশকে কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পাশাপাশি বেড়েছে জনবসতি ও কৃষিজমি। এতে করে কমেছে চিত্রা হরিণের আবাসস্থল, হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্যও। দ্বীপের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ায় কমতে শুরু করেছে পর্যটক।

ছোট-বড় ১১টি চর নিয়ে গড়ে ওঠা নিঝুম দ্বীপ ২০১৩ সালে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র একটি ইউনিয়নের মর্যাদা পায়। স্থানীয়রা বলছেন, দ্বীপটিকে ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে ঘোষণাই কাল হয়েছে বনের জন্য। গত দেড় দশকে বনাঞ্চল উজাড়ে সুযোগ নিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ আওয়ামী লীগের দেড় ডজন নেতাকর্মী। এ কাজে জড়িত রয়েছেন বন বিভাগের এক বোটম্যানও। শতাধিক মামলা করেও রোখা যায়নি তাদের।

হাতিয়ার এ দ্বীপের বন্দরটিলা থেকে বেশ কয়েক মাইল পশ্চিমে রয়েছে হরিণ বাজার। সেখান থেকে মেঠোপথ ধরে কিছুটা দূরে মদিনা গ্রাম। মাঝে মাঝে দিতে হয় নালা পাড়ি। যতদূর চোখ যায় শত শত একর ফসলি জমি। মাঝে মাঝে নতুন বসতিও চোখে পড়ে। কিছুটা পথ হেঁটে গেলেই ফসলি জমিতে দেখা মেলে অর্ধমৃত কেওড়া গাছ। আরেকটু হাঁটলেই গহিন বন। সেখানে গিয়েও দেখা যায় গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ায়

শুকিয়ে আছে হাজার হাজার গাছের গোড়া। কিছু অংশ দেখলে মনে হয় দেড়-দুই মাস আগে কাটা হয়েছে। আবার কিছু রয়েছে পুরনো।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাঁচ দশক আগে থেকে নিঝুম দ্বীপে বনায়ন শুরু হয়। এখনো দ্বীপের আশপাশের চরাঞ্চলে বন বিভাগ বনায়ন অব্যাহত রেখেছে। দাপ্তরিকভাবে দ্বীপের বনায়নের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বন বিভাগ, স্থানীয় বাসিন্দাসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, মূল দ্বীপে প্রায় ১২ হাজার একর বনায়ন ছিল, যা বর্তমানে ঠেকেছে সাড়ে ছয় হাজারে। সে হিসেবে বলা চলে দ্বীপে অর্ধেক বনায়ন কমেছে।

ফারুক হোসেন, নিজাম উদ্দিন, ভুট্টু মিয়া ও মো. আশরাফ হোসেনসহ কথা হয় স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান, মূলত বন উজাড় শুরু হয়েছে নব্বইয়ের দশকে সেলিম নামে একজনের হাত ধরে। তার নেতৃত্বে কখনো আড়ালে আবার কখনো প্রকাশ্যে বনের গাছ কাটা হয়েছে। তবে বন উজাড়ের তীব্রতা বেড়েছে ২০০৮ সালে দ্বীপকে ইউনিয়ন পরিষদ ঘোষণার পর থেকে। তখনই বসতি স্থাপন করতে বনায়ন ধ্বংস করা হয়েছে। 

পরবর্তী সময়ে ২০১১-২১ পর্যন্ত নির্বিচারে গাছ কেটেছেন তৎকালীন চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন। তার সময়ে নিঝুম দ্বীপের মোক্তারিয়া ঘাট, বন্দরটিলা, ছোয়াখালীসহ আশপাশের বনের গাছ কাটা হয়েছে। শুধু মেহরাজ উদ্দিন নন, বন উজাড় করেছেন মোজাক্কের হোসেন ওরফে রতন মাস্টার, কেফায়েত মেম্বার, খবির মেম্বার, মিজান মেম্বার, আলাউদ্দিন, এনায়েত, চান মিয়া, পিস্তল ফারুক, মো. রাসেল ওরফে ডাকাত রাসেল, ছালাউদ্দিন বগি, সেলিম, সামছু উদ্দিন, শাওন, মো. সোহেল ওরফে ডাকাত সোহেলসহ অন্তত দেড় ডজন আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি।

শত শত একর বন কেটে তা বিক্রির অভিযোগ রয়েছে বন বিভাগের বোটম্যান আশরাফের বিরুদ্ধেও। ৫ আগস্টের বন উজাড়ের সঙ্গে জড়িতদের বেশির ভাগই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এ কারণে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও পাওয়া যায়নি।

তবে দ্বীপের বাসিন্দারা বলছেন, প্রথমে বনের মধ্যে দাগ দেয়া হতো। কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় দাগ দিয়ে পরে সেটা ভূমিহীনদের কাছে বিক্রি করা হতো। এরপর দাগ দেয়া বন কেটে উজাড় করা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে। বেনামে দখলে রাখা শত শত একর জমিতে চাষাবাদও করা হয়।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নোয়াখালী-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছত্রছায়ায় বন উজাড় হয়েছে। এসব ঘটনায় বন বিভাগ মামলাও করেছে শতাধিক। তবে তাতে কোনো সুফল মেলেনি।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ  বলেন, ‘আমি এখানে যোগদান করেছি বেশি সময় হয়নি। তবে এরই মধ্যে নিঝুম দ্বীপ নিয়ে প্রশাসন কাজ শুরু করেছে। ভূমি প্রশাসন থেকে জরিপ পরিচালনার জন্য অনুমতি দিয়েছে। দ্রুত বন বিভাগ ও ভূমি বিভাগ যৌথ আলোচনা করে জরিপ কার্যক্রম শুরু করবে। তাহলে জাতীয় উদ্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের জায়গা আলাদা করে বন বিভাগের সীমানা চিহ্নিত করা যাবে।’

বন বিভাগের একটি সূত্র বলছে, একদিকে কয়েক দশকে প্রভাবশালীরা বন কেটেছে। অন্যদিকে ভূমি প্রশাসনের একটি চক্র জাতীয় উদ্যানের জায়গা গোপনে বন্দোবস্ত দিচ্ছে। ফলে বসতি গড়ে উঠলেও বন বিভাগ সেখানে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু ইউসুফ বলেন, ‘বিগত সময়ে বন কাটলেও বর্তমানে তা বন্ধ হয়েছে। বন কাটা নিয়ে দেড় দশক আগে বন্দুকযুদ্ধও হয়েছে নিঝুম দ্বীপে। এতে একজন মারাও গেছেন। জনবল সংকটের কারণে হাজার চেষ্টা করেও অনেক সময় সফল হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে কয়েক বছর ধরে স্থানীয়দের সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে বন বিভাগ।’

এদিকে বন কমে যাওয়ায় জীববৈচিত্র্য পড়েছে হুমকির মুখে। এক সময় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও বন্য প্রাণীর দেখা মিলত। দ্বীপের বেশির ভাগ বনে বানরও ছিল, যা এখন চোখে পড়ে না। বনে প্রচুর হরিণ থাকার কারণে প্রায় সময় লোকালয়ে চলে আসত। শীতে নিঝুম দ্বীপে পর্যটক আসত। এখন দর্শনার্থীরা নিঝুম দ্বীপে এসে হরিণ দেখতে পায় না।

নিঝুম দ্বীপ রক্ষায় নতুন বনায়ন অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু ইউসুফ বলেন, ‘বারবার ভূমি প্রশাসনে লিখিত দেয়া হয়েছে, জেলা সমন্বয় ও আইন-শৃঙ্খলা সভায় দ্বীপসহ হাতিয়ার বনায়ন নিয়েও কথা হয়। দ্বীপে জরিপ করে জাতীয় উদ্যানের জায়গা ও ইউনিয়ন পরিষদের জায়গা মেপে বুঝিয়ে দিতে বারবার চিঠি চালাচালিও হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভূমি প্রশাসন জাতীয় উদ্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের জায়গা বুঝিয়ে দিতে উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে কিছু সমস্যা প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে। তবে বন বিভাগের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারা এবং স্থানীয়রা আরো সচেতন না হলে দ্বীপ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।’

-B

Share this post



Also on Bangladesh Monitor