রহস্যময় 'আলীর সুড়ঙ্গ': প্রকৃতির গহীনে এক পাহাড়ি বিস্ময়

-মনিটর রিপোর্ট Date: 14 September, 2025
রহস্যময় 'আলীর সুড়ঙ্গ': প্রকৃতির গহীনে এক পাহাড়ি বিস্ময়

বান্দরবান :  জেলার আলীকদম উপজেলায় অবস্থিত ‘আলীর সুড়ঙ্গ’ শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়—এটি এক রহস্যময় প্রাকৃতিক বিস্ময়। আলীকদম সদর থেকে মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে ‘আলীর পাহাড়’-এর বুকে লুকিয়ে থাকা এই গুহামালা ঘিরে রয়েছে ইতিহাস, জনশ্রুতি ও রোমাঞ্চের মিশেল।

মাতামুহুরী ও তৈন খাল ঘেঁষে অবস্থিত দুটি পাহাড়ের চূড়ায় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে একাধিক সুড়ঙ্গ। এর মধ্যে মূলত ৩ থেকে ৪টি সুড়ঙ্গ বেশি পরিচিত, যেগুলো প্রাকৃতিক গঠনেই সৃষ্টি। গুহাগুলো ঝিরিপথ থেকে প্রায় ১৫০ ফুট ওপরে এবং গুহার ভেতরের পরিবেশ একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পর্যটকদের টর্চলাইট বা মশাল ছাড়া প্রবেশ একপ্রকার অসম্ভব।

গুহার অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি বাদুড়ের প্রজাতি বাস করে। কিছু সুড়ঙ্গ প্রায় ১০০ ফুট দীর্ঘ, আবার কিছু সুড়ঙ্গ পাহাড়ের এক পাশ থেকে অন্য পাশে গিয়ে শেষ হয়েছে। গুহার মুখে ওঠার জন্য লোহার সিঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে, তবে ভেতরের পথে রয়েছে পিচ্ছিল পাথুরে পথ, যেখান দিয়ে উঠতে দড়ি বা লতার সাহায্য নিতে হয়। বর্ষাকালে ঝিরিপথে পানি বেড়ে গেলে প্রবেশ আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

নামের পেছনে ইতিহাস ও জনশ্রুতি

‘আলীর সুড়ঙ্গ’ নামটির পেছনে নির্দিষ্ট কোনো প্রামাণ্য ইতিহাস নেই, তবে রয়েছে নানা জনশ্রুতি ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা। একটি মতে, ‘আলীকদম’ নামটি এসেছে পালি শব্দ ‘আলোক্যডং’ থেকে, যার অর্থ ‘পাহাড় ও নদীর মধ্যবর্তী স্থান’। ইতিহাসবিদদের মতে, নবম শতকে আরাকানিদের শাসনে থাকা এই অঞ্চল পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে বাংলার সুলতান জালালউদ্দিনের অধীনে আসে এবং ১৭৫৬ সালে মুঘলরা এটি জয় করে।

আরাকানের ১৮ জন রাজার মুসলিম উপাধি গ্রহণের কথাও ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। তাদের মধ্যে রাজা মাং খারির উপাধি ছিল ‘আলী খাঁন’ এবং থাজাথার উপাধি ছিল ‘আলী শাহ’। ধারণা করা হয়, এই নামগুলোর প্রভাবেই ‘আলীকদম’ এবং ‘আলীর সুড়ঙ্গ’ নামের উৎপত্তি।

অন্য একটি জনপ্রিয় জনশ্রুতি অনুসারে, হযরত শাহজালালের নেতৃত্বে যখন ৩৬০ আউলিয়া সিলেটে আগমন করেন, তখন তাদের একটি অংশ পার্বত্য এলাকায় আসেন। তাদের মধ্যে 'আলী' নামের কোনো একজন আউলিয়ার নামেই হয়তো এই গুহা ও অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে।

স্থানীয়দের মতে, যে পাহাড়ে গুহাগুলো অবস্থিত তার নাম ‘আলীর পাহাড়’, ফলে ‘আলীকদম’, ‘আলীর পাহাড়’ এবং ‘আলীর সুড়ঙ্গ’—তিনটি নামই একই সূত্রে গাঁথা বলে ধরা হয়।

প্রাকৃতিক রোমাঞ্চ ও পর্যটনের সম্ভাবনা

আলীর সুড়ঙ্গ এখন একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। বিভিন্ন মৌসুমে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে ভিড় জমান। সরকার পর্যটকদের সুবিধার্থে এই এলাকায় দৃষ্টিনন্দন সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণ করেছে।

ঢাকা থেকে যেতে হলে প্রথমে চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারের চকরিয়া বাস টার্মিনালে পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে বাস বা ইজিবাইকে আলীকদম উপজেলা সদরে পৌঁছে স্থানীয় যানবাহনে তৈন খালের ওপর নির্মিত ব্রিজ পার হয়ে হেঁটে আলীর সুড়ঙ্গে যেতে হয়।

এছাড়াও, বান্দরবান হয়ে দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক—ডিম পাহাড়ের ওপর দিয়ে আলীকদমে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে, যা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে পর্যটনে। এই রুটে এসে মাতামুহুরী নদীর তীরে অবস্থিত আলীর পাহাড় এবং গুহায় পৌঁছানো যায়।

প্রশাসনের উদ্যোগ ও পর্যটকদের জন্য বার্তা

আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মোমিন জানান, “যেসব পর্যটক পাহাড়ে এসে ইউনিক কিছু দেখতে চান বা পাহাড়ি সুড়ঙ্গসহ প্রকৃতি উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য ‘আলীর সুড়ঙ্গ’ একটি অসাধারণ গন্তব্য হতে পারে। নিরাপত্তা ও অন্যান্য সহায়ক ব্যবস্থা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।”

সতর্কতা অবলম্বন জরুরি

‘আলীর সুড়ঙ্গ’ নিঃসন্দেহে একটি রোমাঞ্চকর গন্তব্য, তবে সেখানে ভ্রমণের সময় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। বিশেষত বর্ষাকালে ঝিরিপথে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে কিছুটা ঝুঁকি থাকতে পারে।

পর্যটকরা চাইলে আলীকদমের পথে পোয়ামুহুরী সড়কের দৃষ্টিনন্দন ভিউ পয়েন্টগুলোও উপভোগ করতে পারেন।

-B

Share this post



Also on Bangladesh Monitor